সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের সমাপ্তি - বেনজীর আহমেদ
‘সুন্দরবন’ আমাদের গর্ব, আমাদের জীবিকা, আমাদের ঐতিহ্য। এটি শুধু আমাদের নয়, সমগ্র পৃথিবীর ঐতিহ্য। ২২ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে ইউনেস্কো কর্তৃক সুন্দরবনকে ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর পর্যটক তথা সারা বিশ্বেই সুন্দরবনের কদর বহুলাংশে বেড়ে গেছে। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যার আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিমি। সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যেমন বিখ্যাত, তেমনি এখানে রয়েছে হাজারো প্রাকৃতিক সম্পদ। সুন্দরবনে প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক যান এর সৌন্দর্য দেখতে। আর সুন্দরবন সংলগ্ন লাখ লাখ পেশাজীবী যান জীবিকার সন্ধানে। তা ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের লোকালয়গুলোকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। উপকূলীয় তথা সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষগুলোর রুটি-রুজির জন্য নির্ভর করে থাকতে হয় এই সুন্দরবন ও সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা অসংখ্য নদী ও খালবিলের ওপর। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যও এই সুন্দরবন। কিন্তু আশির দশকে সুন্দরবনে নেমে আসে এক অভিশাপ, শুরু হয় এক কলঙ্কিত অধ্যায়; তার নাম ‘জলদস্যু’। সেই আশির দশক থেকে কয়েক মাস আগ পর্যন্ত এই জলদস্যুদের চাঁদাবাজি, অপহরণ আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রার্থনা করেছে সৃষ্টিকর্তার কাছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কবে মিলবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।
সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। এদের কেউ জেলে, কেউ বাওয়ালি, কেউ মৌয়ালি। অতি দরিদ্র ও ভূমিহীনরাই সাধারণত এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। প্রতিনিয়ত বাঘ, কুমির ও সাপ আর হাজারো বিপদের মুখে এই দরিদ্র মানুষগুলো যান শুধু পরিবারের সদস্যদের মুখে বেঁচে থাকার মতো আহার তুলে দেওয়ার জন্য। যারা সুন্দরবনে এসব পেশাজীবীর জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি নিজের চোখে দেখেননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না সেখানে জীবিকা অর্জন কতটা কঠিন, কষ্টকর আর বিপজ্জনক। একটি ছোট নৌকায় শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে জেলেরা ৭ দিনের জন্য চলে যান মাছ অথবা কাঁকড়া ধরতে। জঙ্গলে বাঘ থাকে বলে সেখানে টয়লেটের জন্য মাটিতে নামা বিপজ্জনক, তাই ইচ্ছে করেই জেলেরা অল্প পরিমাণে শুকনো খাবার (মুড়ি, চিঁড়া, বিস্কুট) খায় যেন টয়লেটে কম যেতে হয়। কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী একত্রে নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে যায় রোজগার বাড়াতে। এমনো দেখা যায়, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকেও তারা নৌকার মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়, বাড়িতে কারও কাছে রেখে যাওয়ার মতো কেউ নেই বলে। এই মাসুম বাচ্চাগুলো ঝড়-বৃষ্টি আর কনকনে শীতের মধ্যে বড় হতে থাকে হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে। আর বাবা-মা মাছ ধরার পাশাপাশি পালা করে বাচ্চাকে পাহারা দেন, কখন না আবার বাচ্চা পানিতে পড়ে যায়। একে তো পেটে খাবার নেই, তার সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, বাড়তি হিসেবে জোটে নির্ঘুম রাত আর জলের কুমির, ডাঙার বাঘ তো আছেই। সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের মতো এত কষ্টকর আর চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে। এত বিপদ মাথায় নিয়ে আর রক্ত পানি করা পরিশ্রম করেও যা জোটে তাও খুবই সামান্য। যা দিয়ে হয়তো কোনো মতে পরিবারের বৃদ্ধ, শিশুসহ সবার বেঁচে থাকার জন্য আহার জোটে।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের এত বিপদের চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর এক বিপদ রয়েছে যার নাম ‘জলদস্যু’। আশির দশকে অস্ত্র নিয়ে সর্বপ্রথম সুন্দরবনে জলদস্যুতা শুরু করে ‘গনি বাহিনী’। সুন্দরবনে যাওয়া বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে চাঁদা আদায় করা আর চাঁদা না পেলে মাছ, মধু লুট করে নিয়ে যেত তারা। পরবর্তীতে সারা সুন্দরবনজুড়ে আরও অনেক জলদস্যু বাহিনী এলাকা ভাগ করে নিয়ে দস্যুতা শুরু করে। আর চাঁদা আদায়ের জন্য তারা ব্যবহার শুরু করে ‘টোকেন’ ব্যবস্থা। জলদস্যু দলগুলো তাদের দখল করা এলাকায় আসা পেশাজীবীদের সবার টোকেন চেক করে দেখে। কারও কাছে টোকেন না পাওয়া গেলে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাই সুন্দরবনে যাওয়ার আগে প্রত্যেক জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিকে সংগ্রহ করতে হয় জলদস্যুদের টোকেন। একেকটি টোকেনের মূল্য ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সুন্দরবন সংলগ্ন ও উপকূলীয় লোকালয়গুলোতে ভদ্রবেশে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের এজেন্টরাই এই টোকেনগুলো সুন্দরবনের পেশাজীবীদের কাছে বিক্রি করে। বিনিময়ে টোকেন বিক্রির একটি অংশ তারা পায়।
জলদস্যুদের বিচরণ সুন্দরবন জুড়ে। পাথরঘাটা থেকে শ্যামনগর কোথাও স্বস্তি নেই এই মানুষরূপী জলদস্যুদের অত্যাচার। ইলিশ ধরার মৌসুমে জলদস্যুরা তাদের দ্রুতগামী ট্রলারগুলো নিয়ে হায়েনার মতো ছুটে যায় সাগরেও। সেখানে মাছ ধরার ট্রলারগুলো থেকে লুট করে নেয় মাছ আর জাল। কোনো ট্রলারে যদি টোকেন না পাওয়া যায় তবে ওই ট্রলারের জেলেদের অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। পরে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনে তাদের পরিবার অথবা মালিক। পারিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অতি আপনজনকে জলদস্যুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে অনেক সময় শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয় পরিবারগুলোকে। মুক্তিপণ গড়ে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। হতদরিদ্র পেশাজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের আয়ের বিনিময়ে টোকেনের টাকা আর ভিটেমাটি বিক্রির মুক্তিপণের টাকায় জলদস্যুরা যাপন করে বিলাসী জীবন।
কী নেই জলদস্যুদের ট্রলারে! বিদেশি জুস, ফলমূল, দামি বডিলোশন, চুলের মেহেদি, বিভিন্ন ধরনের খাবার। ট্রলারে রয়েছে শুষ্ক ও তাজা খাবার সংরক্ষণের স্টোর। বেশির ভাগ ডাকাতের ট্রলারই স্টিল অথবা লোহার পুরু পাত দিয়ে বুলেট প্রুফ করা। আমোদ-প্রমোদেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর, মদ, গান-বাজনা, নেশাদ্রব্য তো আছেই। এ ছাড়াও বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লী ও বিভিন্ন লোকালয় থেকে টাকার বিনিময়ে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত দলের প্রমোদের জন্য। দরিদ্র মানুষের ঘাম ঝরানো হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা লুণ্ঠন করে এভাবেই দুহাতে খরচ করে হায়েনার দল। আর বাজার সদাই থেকে শুরু করে মেয়ে মানুষ সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে লোকালয়ে থাকা কিছু ভদ্রবেশী ব্যক্তি, যার বিনিময়ে ডাকাত দলের লুণ্ঠিত অবৈধ রোজগারের একটা বড় অংশ পেয়ে যায় তারা।
জলদস্যুরা সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের অত্যাচারের পাশাপাশি মারাত্মক ক্ষতি করছে সুন্দরবনেরও। আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে গুলি করে হত্যা করে সেই বাঘের চামড়া ও হাড় কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। নিজেরা খাওয়ার জন্য ও মাংস বিক্রি করার জন্য অবাধে শিকার করছে হরিণ। হরিণের চামড়াও বিক্রি করে দিচ্ছে অবৈধভাবে। তা ছাড়া নিজেরা থাকা ও রান্না করার জন্য সুন্দরবনের গাছ কেটে নষ্ট করছে। দিন দিন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ জলদস্যু কর্তৃক অবাধে বাঘ হত্যা করা। র্যাব এ যাবৎ জলদস্যু কর্তৃক হত্যা করা বাঘ ও হরিণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চামড়া উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করা বাঘ ও হরিণের চামড়াগুলো জলদস্যু কর্তৃক শিকারের পরবর্তীতে অবৈধ চোরাকারবারিদের হাতে গেছে। অবাধে বাঘ ও হরিণ শিকার এবং গাছ ও জঙ্গল কেটে ফেলার কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলা।
আশির দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে অনেক জলদস্যু দল দস্যুতা করে আসছে। এদের মধ্যে উল্লেযোগ্য বাহিনীগুলো হচ্ছে ‘শীর্ষ বাহিনী’, ‘ফেরাউন বেল্লাল’, ‘কাসেম বাহিনী’, ‘মাস্টার বাহিনী’, ‘রাজু বাহিনী’, ‘আলিম বাহিনী’ প্রভৃতি। বড় জলদস্যু বাহিনীগুলোর মাসিক আয় গড়ে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকা। আর ছোট বাহিনীগুলোর ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা। বড় বাহিনীগুলোর প্রায় সব অস্ত্রই বিদেশি। এরা আমেরিকা, তুরস্ক ও ভারতে তৈরি অস্ত্র বেশি ব্যবহার করে। নাইন শুটার, এইট শুটার, সিং শুটার, ডাবল ব্যারেল, সিঙ্গেল ব্যারেল, এ কে.২২ অস্ত্রগুলোই বেশি ব্যবহার হয়। আর ছোট দলগুলো দেশীয় বন্দুক, এলজি, ওয়ান শুটার প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
আশির দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শতাধিক জলদস্যু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষ বাহিনীর প্রধান শীর্ষ, ফেরাউন বেল্লাল বাহিনীর প্রধান বেল্লাল, কাসেম বাহিনীর প্রধান কাসেম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে র্যাবই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মতিতে র্যাবের ক্রমাগত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া জলদস্যুরা ২০১৬ সাল থেকে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করে। ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি র্যাবের কাছে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে ১০টি জলদস্যু বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান আর দস্যুদলগুলোর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় সমাপ্তির পথে সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের। গোয়েন্দা তথ্য মতে, আর দু-তিনটি বাহিনী এখনো সুন্দরবনে দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই হয়তো এগুলোও আত্মসমর্পণ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্য দিয়ে নির্মূল হয়ে যাবে। অভিশাপমুক্ত হচ্ছে আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য সুন্দরবন। নিরাপত্তা, শান্তি আর আস্থা ফিরে আসছে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর মাঝে। নিরাপদ হচ্ছে আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর চিত্রা হরিণ। আগামীতে হয়তো বাঘ আর হরিণের পরিসংখ্যানে আমরা এর সুফল দেখতে পাব।
Posted by কয়রার সংবাদ
সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। এদের কেউ জেলে, কেউ বাওয়ালি, কেউ মৌয়ালি। অতি দরিদ্র ও ভূমিহীনরাই সাধারণত এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। প্রতিনিয়ত বাঘ, কুমির ও সাপ আর হাজারো বিপদের মুখে এই দরিদ্র মানুষগুলো যান শুধু পরিবারের সদস্যদের মুখে বেঁচে থাকার মতো আহার তুলে দেওয়ার জন্য। যারা সুন্দরবনে এসব পেশাজীবীর জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি নিজের চোখে দেখেননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না সেখানে জীবিকা অর্জন কতটা কঠিন, কষ্টকর আর বিপজ্জনক। একটি ছোট নৌকায় শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে জেলেরা ৭ দিনের জন্য চলে যান মাছ অথবা কাঁকড়া ধরতে। জঙ্গলে বাঘ থাকে বলে সেখানে টয়লেটের জন্য মাটিতে নামা বিপজ্জনক, তাই ইচ্ছে করেই জেলেরা অল্প পরিমাণে শুকনো খাবার (মুড়ি, চিঁড়া, বিস্কুট) খায় যেন টয়লেটে কম যেতে হয়। কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী একত্রে নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে যায় রোজগার বাড়াতে। এমনো দেখা যায়, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকেও তারা নৌকার মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়, বাড়িতে কারও কাছে রেখে যাওয়ার মতো কেউ নেই বলে। এই মাসুম বাচ্চাগুলো ঝড়-বৃষ্টি আর কনকনে শীতের মধ্যে বড় হতে থাকে হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে। আর বাবা-মা মাছ ধরার পাশাপাশি পালা করে বাচ্চাকে পাহারা দেন, কখন না আবার বাচ্চা পানিতে পড়ে যায়। একে তো পেটে খাবার নেই, তার সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, বাড়তি হিসেবে জোটে নির্ঘুম রাত আর জলের কুমির, ডাঙার বাঘ তো আছেই। সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের মতো এত কষ্টকর আর চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে। এত বিপদ মাথায় নিয়ে আর রক্ত পানি করা পরিশ্রম করেও যা জোটে তাও খুবই সামান্য। যা দিয়ে হয়তো কোনো মতে পরিবারের বৃদ্ধ, শিশুসহ সবার বেঁচে থাকার জন্য আহার জোটে।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের এত বিপদের চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর এক বিপদ রয়েছে যার নাম ‘জলদস্যু’। আশির দশকে অস্ত্র নিয়ে সর্বপ্রথম সুন্দরবনে জলদস্যুতা শুরু করে ‘গনি বাহিনী’। সুন্দরবনে যাওয়া বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে চাঁদা আদায় করা আর চাঁদা না পেলে মাছ, মধু লুট করে নিয়ে যেত তারা। পরবর্তীতে সারা সুন্দরবনজুড়ে আরও অনেক জলদস্যু বাহিনী এলাকা ভাগ করে নিয়ে দস্যুতা শুরু করে। আর চাঁদা আদায়ের জন্য তারা ব্যবহার শুরু করে ‘টোকেন’ ব্যবস্থা। জলদস্যু দলগুলো তাদের দখল করা এলাকায় আসা পেশাজীবীদের সবার টোকেন চেক করে দেখে। কারও কাছে টোকেন না পাওয়া গেলে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাই সুন্দরবনে যাওয়ার আগে প্রত্যেক জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিকে সংগ্রহ করতে হয় জলদস্যুদের টোকেন। একেকটি টোকেনের মূল্য ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সুন্দরবন সংলগ্ন ও উপকূলীয় লোকালয়গুলোতে ভদ্রবেশে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের এজেন্টরাই এই টোকেনগুলো সুন্দরবনের পেশাজীবীদের কাছে বিক্রি করে। বিনিময়ে টোকেন বিক্রির একটি অংশ তারা পায়।
জলদস্যুদের বিচরণ সুন্দরবন জুড়ে। পাথরঘাটা থেকে শ্যামনগর কোথাও স্বস্তি নেই এই মানুষরূপী জলদস্যুদের অত্যাচার। ইলিশ ধরার মৌসুমে জলদস্যুরা তাদের দ্রুতগামী ট্রলারগুলো নিয়ে হায়েনার মতো ছুটে যায় সাগরেও। সেখানে মাছ ধরার ট্রলারগুলো থেকে লুট করে নেয় মাছ আর জাল। কোনো ট্রলারে যদি টোকেন না পাওয়া যায় তবে ওই ট্রলারের জেলেদের অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। পরে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনে তাদের পরিবার অথবা মালিক। পারিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অতি আপনজনকে জলদস্যুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে অনেক সময় শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয় পরিবারগুলোকে। মুক্তিপণ গড়ে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। হতদরিদ্র পেশাজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের আয়ের বিনিময়ে টোকেনের টাকা আর ভিটেমাটি বিক্রির মুক্তিপণের টাকায় জলদস্যুরা যাপন করে বিলাসী জীবন।
কী নেই জলদস্যুদের ট্রলারে! বিদেশি জুস, ফলমূল, দামি বডিলোশন, চুলের মেহেদি, বিভিন্ন ধরনের খাবার। ট্রলারে রয়েছে শুষ্ক ও তাজা খাবার সংরক্ষণের স্টোর। বেশির ভাগ ডাকাতের ট্রলারই স্টিল অথবা লোহার পুরু পাত দিয়ে বুলেট প্রুফ করা। আমোদ-প্রমোদেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর, মদ, গান-বাজনা, নেশাদ্রব্য তো আছেই। এ ছাড়াও বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লী ও বিভিন্ন লোকালয় থেকে টাকার বিনিময়ে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত দলের প্রমোদের জন্য। দরিদ্র মানুষের ঘাম ঝরানো হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা লুণ্ঠন করে এভাবেই দুহাতে খরচ করে হায়েনার দল। আর বাজার সদাই থেকে শুরু করে মেয়ে মানুষ সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে লোকালয়ে থাকা কিছু ভদ্রবেশী ব্যক্তি, যার বিনিময়ে ডাকাত দলের লুণ্ঠিত অবৈধ রোজগারের একটা বড় অংশ পেয়ে যায় তারা।
জলদস্যুরা সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের অত্যাচারের পাশাপাশি মারাত্মক ক্ষতি করছে সুন্দরবনেরও। আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে গুলি করে হত্যা করে সেই বাঘের চামড়া ও হাড় কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। নিজেরা খাওয়ার জন্য ও মাংস বিক্রি করার জন্য অবাধে শিকার করছে হরিণ। হরিণের চামড়াও বিক্রি করে দিচ্ছে অবৈধভাবে। তা ছাড়া নিজেরা থাকা ও রান্না করার জন্য সুন্দরবনের গাছ কেটে নষ্ট করছে। দিন দিন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ জলদস্যু কর্তৃক অবাধে বাঘ হত্যা করা। র্যাব এ যাবৎ জলদস্যু কর্তৃক হত্যা করা বাঘ ও হরিণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চামড়া উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করা বাঘ ও হরিণের চামড়াগুলো জলদস্যু কর্তৃক শিকারের পরবর্তীতে অবৈধ চোরাকারবারিদের হাতে গেছে। অবাধে বাঘ ও হরিণ শিকার এবং গাছ ও জঙ্গল কেটে ফেলার কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলা।
আশির দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে অনেক জলদস্যু দল দস্যুতা করে আসছে। এদের মধ্যে উল্লেযোগ্য বাহিনীগুলো হচ্ছে ‘শীর্ষ বাহিনী’, ‘ফেরাউন বেল্লাল’, ‘কাসেম বাহিনী’, ‘মাস্টার বাহিনী’, ‘রাজু বাহিনী’, ‘আলিম বাহিনী’ প্রভৃতি। বড় জলদস্যু বাহিনীগুলোর মাসিক আয় গড়ে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকা। আর ছোট বাহিনীগুলোর ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা। বড় বাহিনীগুলোর প্রায় সব অস্ত্রই বিদেশি। এরা আমেরিকা, তুরস্ক ও ভারতে তৈরি অস্ত্র বেশি ব্যবহার করে। নাইন শুটার, এইট শুটার, সিং শুটার, ডাবল ব্যারেল, সিঙ্গেল ব্যারেল, এ কে.২২ অস্ত্রগুলোই বেশি ব্যবহার হয়। আর ছোট দলগুলো দেশীয় বন্দুক, এলজি, ওয়ান শুটার প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
আশির দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শতাধিক জলদস্যু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষ বাহিনীর প্রধান শীর্ষ, ফেরাউন বেল্লাল বাহিনীর প্রধান বেল্লাল, কাসেম বাহিনীর প্রধান কাসেম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে র্যাবই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মতিতে র্যাবের ক্রমাগত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া জলদস্যুরা ২০১৬ সাল থেকে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করে। ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি র্যাবের কাছে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে ১০টি জলদস্যু বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান আর দস্যুদলগুলোর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় সমাপ্তির পথে সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের। গোয়েন্দা তথ্য মতে, আর দু-তিনটি বাহিনী এখনো সুন্দরবনে দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই হয়তো এগুলোও আত্মসমর্পণ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্য দিয়ে নির্মূল হয়ে যাবে। অভিশাপমুক্ত হচ্ছে আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য সুন্দরবন। নিরাপত্তা, শান্তি আর আস্থা ফিরে আসছে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর মাঝে। নিরাপদ হচ্ছে আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর চিত্রা হরিণ। আগামীতে হয়তো বাঘ আর হরিণের পরিসংখ্যানে আমরা এর সুফল দেখতে পাব।
Posted by কয়রার সংবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন