মানুষ বিক্রির হাট কাজের সন্ধানে যাদের থাকতে হয় অপেক্ষায়
কয়রা ডেস্ক : ছেলের বাবা একদিন কথার ছলে বলেছিলেন শিববাড়ি মোড়ে মানুষ বিক্রি হয়। কাজে গেলে টাকা পাওয়া যায়। কথাটি মনে ছিল বলেই স্বামী যখন আর একটি বিয়ে করে অন্যত্র চয়ে যান তখন নিজেই চলে আসি খুলনার শিববাড়ি মোড়ে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরই বিক্রি হয়ে যাই। পরে আবারও। এভাবে আসি আর বিক্রি হই। যেদিন বিক্রি হতে না পারি সেদিন ১০টার পর বাড়ি ফিরে যাই। এভাবেই চলছে আমার সংসার।’
কথাগুলো বললেন রূপসা উপজেলার রাজাপুরের রেবা খাতুন। সাথে ছিলেন ছেলে রাসেলও। মা-ছেলে কখনও এক বাড়িতে আবার কখনও পৃথক জায়গায় কাজে যান হয় শিববাড়ি মোড় থেকে নতুবা ময়লাপোতা থেকে অথবা সাত রাস্তার মোড় থেকে।
মা রেবা খাতুন আর ছেলে রাসেলের মত আরও অনেক লোক পাওয়া যাবে নগরীর উল্লিখিত জায়গায়। যারা শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কেউ কোদাল, কুর্নিক, ওলন, টেপসহ অবস্থান করেন এসব স্থানে। শ্রম বিক্রির হাট বসে শহর থেকে একটু বাইরে ফুলতলা, ডুমুরিয়া, শাহপুরসহ অনেক স্থানেও। এসব শ্রম বাজার ঘুরে এবং শ্রমজীবী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস সম্পর্কে ধারণা নেই। শুধু জানেন পয়লা মে কাজ বন্ধ থাকে। তবে অধিকাংশ লোকই জানালেন, ‘আমাদের কাজ বন্ধ রাখলেতো পেট(সংসার) চলবে না। সংসার চালাতে তাই কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান প্রতিনিয়ত। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন দেয়া সেই আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘন্টা শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ খুলনার শ্রম বাজারের শ্রমিকদের বেলায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও অন্তত একটা নিয়ম-শৃংখলার মধ্যেই যে শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ হয়েছে তাই স্বীকার করলেন কেউ কেউ। যেটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অবদান বলেও উল্লেখ করেন সচেতন কয়েকজন শ্রমিক।
খুলনার তেরখাদা উপজেলা থেকে শিববাড়ি মোড়ে কাজের সন্ধানে আসেন শের আলী নামের এক ব্যক্তি। বর্তমানে নগরীর নিউ মার্কেটের পেছনে একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন। বললেন, মাসের ১৫/২০ দিন হয়ত কাজ পাওয়া যায়। বাকী দিনগুলো বসে থাকতে হয়। এমনিভাবে যদি কাজ না পাওয়া যায় তাহলে এমনিতেইতো বিনা কাজে দিন কাটাতে হবে। তবে কাজ পাওয়া গেলে বন্ধ রাখার পক্ষে নয় তিনি। কেননা একদিন কাজ বন্ধ রাখলে তিনি ৪/৫শ’ টাকা থেকে বঞ্চিত হবেন।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার তাফালবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ আলী শেখ নগরীর জোড়াগেট এলাকায় থাকেন। কাজের সন্ধানে তিনিও আসেন শিববাড়ি মোড়ে। ‘কোন দিবস বা সমিতি তার পেটে ভাত দেবে না’ উল্লেখ করে তিনি সাফ জানালেন ‘কাজ করেইতো জীবন চলছে। একদিন কাজ বন্ধ রাখলে কি আমার সংসারে রান্না হবে ?’
আইলা বিদ্ধস্ত কয়রার আ: মান্নান থাকেন নগরীর নিরালা এলাকায়। তিনিও আসেন শিববাড়ি মোড়ে কাজের সন্ধানে। কবে থেকে এমন কাজের সন্ধানে মানুষ শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হয় তা তার জানা নেই। তবে খুলনায় এসেই তিনি মানুষের মাধ্যমেই শুনে এখানে আসেন। যখনই কাজ দরকার তখনই আসেন এখানে। কখনও ময়লাপোতা বা সাতরাস্তার মোড় অথবা বানরগাতি বাজারে তিনি গিয়ে থাকেন কাজের সন্ধানে।
এমনিভাবে মোড়েলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটির রিয়াজুল, মোড়েলগঞ্জ সদরের ফারুক হোসেন, পাথরঘাটার নূরুল হকসহ অনেকের সাথে কথা হয় শিববাড়ি, সাতরাস্তা মোড় ও ময়লাপোতা এলাকায়। তাদের সবারই বক্তব্য ‘কাজের জন্য শহরে এসে কাজবিহীন একটি দিন যেন বড়ই কষ্টের’। কারণ একদিন কাজ না থাকলে পরেরদিন ঋণ নিয়ে অথবা দোকান থেকে বাকীতে বাজার নিতে হয়। মাস শেষে বাসা ভাড়া দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে কাজ বন্ধ করে শ্রমিক দিবস পালনের আর সদিচ্ছা থাকে না।
খুলনা শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের শ্রমিকদের চাহিদা বেশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড়ের পর ধান কাটা ও ধান তোলার জন্য দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিকদের চাহিদা বেশ। এজন্য গত বুধবার জেলার ফুলতলা বাজারে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে। সেখানে অনেক আগে থেকেই চলে আসছে ‘জোন বাজার’। ফুলতলা বাসষ্টান্ড সংলগ্ন ওই ‘জোন বাজার’ কবে থেকে চালু হয় তার সঠিক কোন দিন-তারিখ উল্লেখ করতে না পারলেও স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিক নেতা আ: রশিদ বললেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন এ বাজার। সপ্তাহে দু’দিন রবি ও বুধবার বসে এ বাজার। এ বাজারে খুলনাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেমন শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে আসেন তেমনি আসেন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকেও। এ বাজারে ‘কিষাণ কিনতেও আসেন দিঘলিয়া, গাজীরহাট, গোপালগঞ্জসহ অনেক এলাকা থেকে অনেকে’।
এ বাজারে আসা কয়রার হাবিবুর রহমান বললেন, গত হাটে নওয়াপাড়া থেকে বিক্রি হয়েছিলেন তিনি। যে বাড়িতে কাজে গিয়েছিলেন সে বাড়িতেই আবার লোক দরকার বলে গৃহস্ত(বাড়ির মালিক) ফুলতলার বাজারে আসতে বলেছেন। এজন্য তিনি এসেছেন সেখানে।
কয়রার আবু হানিফ জানান, প্রতি বছরই তিনি শুকনো মৌসুমে আসেন কাজের সন্ধানে। বাকী সময় বাড়িতে ঘের-বেড়ি করেন। সব ধরনের কাজে অভিজ্ঞ আবু হানিফ জানালেন কাজের জন্য শহরে এসে সপ্তাহের প্রতিদিনই তিনি কাজ চান। কারণ কাজ করলেই পয়সা হবে। কাজ না থাকলে শহরে আসার অর্থই বৃথা।
খুলনার যুগ্ম শ্রম পরিচালক অধ্যক্ষ খান আখতার হোসেন বলেন, খুলনা বিভাগে ৬৯৯টি ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় আড়াই লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়নের বাইরেও অনেক শ্রমিক রয়েছেন উল্লেখ করে উপ-শ্রম পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় এবং মালিক-শ্রমিক বিরোধ নিষ্পত্তিই তাদের কাজ। ‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ এ শ্লোগানকে সামনে নিয়েই আজ সোমবার সারাবিশ্বের ন্যায় খুলনায় মহান মে দিবস পালনে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সহকারী শ্রম পরিচালক আবু বিন আলম।
উল্লেখ্য, আগে শ্রমিকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হত। বিপরীতে মজুরী মিলত নগণ্য। এজন্য ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে।
কিন্তু কারখানা মালিকপক্ষ এ দাবি মেনে নেয়নি। ৪ মে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে হাজারো শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় এটি করেছিলেন।
আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ বাহিনী তৎক্ষণাত শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়েটে রূপ নেয়। রায়েটে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।
পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়।
ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, "আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে"। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়েটের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের " দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার" দাবি অফিসিয়ালি স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে প্রতি বছরের পয়লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”।
কথাগুলো বললেন রূপসা উপজেলার রাজাপুরের রেবা খাতুন। সাথে ছিলেন ছেলে রাসেলও। মা-ছেলে কখনও এক বাড়িতে আবার কখনও পৃথক জায়গায় কাজে যান হয় শিববাড়ি মোড় থেকে নতুবা ময়লাপোতা থেকে অথবা সাত রাস্তার মোড় থেকে।
মা রেবা খাতুন আর ছেলে রাসেলের মত আরও অনেক লোক পাওয়া যাবে নগরীর উল্লিখিত জায়গায়। যারা শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কেউ কোদাল, কুর্নিক, ওলন, টেপসহ অবস্থান করেন এসব স্থানে। শ্রম বিক্রির হাট বসে শহর থেকে একটু বাইরে ফুলতলা, ডুমুরিয়া, শাহপুরসহ অনেক স্থানেও। এসব শ্রম বাজার ঘুরে এবং শ্রমজীবী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস সম্পর্কে ধারণা নেই। শুধু জানেন পয়লা মে কাজ বন্ধ থাকে। তবে অধিকাংশ লোকই জানালেন, ‘আমাদের কাজ বন্ধ রাখলেতো পেট(সংসার) চলবে না। সংসার চালাতে তাই কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান প্রতিনিয়ত। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন দেয়া সেই আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘন্টা শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ খুলনার শ্রম বাজারের শ্রমিকদের বেলায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও অন্তত একটা নিয়ম-শৃংখলার মধ্যেই যে শ্রম ঘন্টা নির্ধারণ হয়েছে তাই স্বীকার করলেন কেউ কেউ। যেটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অবদান বলেও উল্লেখ করেন সচেতন কয়েকজন শ্রমিক।
খুলনার তেরখাদা উপজেলা থেকে শিববাড়ি মোড়ে কাজের সন্ধানে আসেন শের আলী নামের এক ব্যক্তি। বর্তমানে নগরীর নিউ মার্কেটের পেছনে একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন। বললেন, মাসের ১৫/২০ দিন হয়ত কাজ পাওয়া যায়। বাকী দিনগুলো বসে থাকতে হয়। এমনিভাবে যদি কাজ না পাওয়া যায় তাহলে এমনিতেইতো বিনা কাজে দিন কাটাতে হবে। তবে কাজ পাওয়া গেলে বন্ধ রাখার পক্ষে নয় তিনি। কেননা একদিন কাজ বন্ধ রাখলে তিনি ৪/৫শ’ টাকা থেকে বঞ্চিত হবেন।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার তাফালবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ আলী শেখ নগরীর জোড়াগেট এলাকায় থাকেন। কাজের সন্ধানে তিনিও আসেন শিববাড়ি মোড়ে। ‘কোন দিবস বা সমিতি তার পেটে ভাত দেবে না’ উল্লেখ করে তিনি সাফ জানালেন ‘কাজ করেইতো জীবন চলছে। একদিন কাজ বন্ধ রাখলে কি আমার সংসারে রান্না হবে ?’
আইলা বিদ্ধস্ত কয়রার আ: মান্নান থাকেন নগরীর নিরালা এলাকায়। তিনিও আসেন শিববাড়ি মোড়ে কাজের সন্ধানে। কবে থেকে এমন কাজের সন্ধানে মানুষ শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হয় তা তার জানা নেই। তবে খুলনায় এসেই তিনি মানুষের মাধ্যমেই শুনে এখানে আসেন। যখনই কাজ দরকার তখনই আসেন এখানে। কখনও ময়লাপোতা বা সাতরাস্তার মোড় অথবা বানরগাতি বাজারে তিনি গিয়ে থাকেন কাজের সন্ধানে।
এমনিভাবে মোড়েলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটির রিয়াজুল, মোড়েলগঞ্জ সদরের ফারুক হোসেন, পাথরঘাটার নূরুল হকসহ অনেকের সাথে কথা হয় শিববাড়ি, সাতরাস্তা মোড় ও ময়লাপোতা এলাকায়। তাদের সবারই বক্তব্য ‘কাজের জন্য শহরে এসে কাজবিহীন একটি দিন যেন বড়ই কষ্টের’। কারণ একদিন কাজ না থাকলে পরেরদিন ঋণ নিয়ে অথবা দোকান থেকে বাকীতে বাজার নিতে হয়। মাস শেষে বাসা ভাড়া দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে কাজ বন্ধ করে শ্রমিক দিবস পালনের আর সদিচ্ছা থাকে না।
খুলনা শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও এ ধরনের শ্রমিকদের চাহিদা বেশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড়ের পর ধান কাটা ও ধান তোলার জন্য দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিকদের চাহিদা বেশ। এজন্য গত বুধবার জেলার ফুলতলা বাজারে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে। সেখানে অনেক আগে থেকেই চলে আসছে ‘জোন বাজার’। ফুলতলা বাসষ্টান্ড সংলগ্ন ওই ‘জোন বাজার’ কবে থেকে চালু হয় তার সঠিক কোন দিন-তারিখ উল্লেখ করতে না পারলেও স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিক নেতা আ: রশিদ বললেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন এ বাজার। সপ্তাহে দু’দিন রবি ও বুধবার বসে এ বাজার। এ বাজারে খুলনাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেমন শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে আসেন তেমনি আসেন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকেও। এ বাজারে ‘কিষাণ কিনতেও আসেন দিঘলিয়া, গাজীরহাট, গোপালগঞ্জসহ অনেক এলাকা থেকে অনেকে’।
এ বাজারে আসা কয়রার হাবিবুর রহমান বললেন, গত হাটে নওয়াপাড়া থেকে বিক্রি হয়েছিলেন তিনি। যে বাড়িতে কাজে গিয়েছিলেন সে বাড়িতেই আবার লোক দরকার বলে গৃহস্ত(বাড়ির মালিক) ফুলতলার বাজারে আসতে বলেছেন। এজন্য তিনি এসেছেন সেখানে।
কয়রার আবু হানিফ জানান, প্রতি বছরই তিনি শুকনো মৌসুমে আসেন কাজের সন্ধানে। বাকী সময় বাড়িতে ঘের-বেড়ি করেন। সব ধরনের কাজে অভিজ্ঞ আবু হানিফ জানালেন কাজের জন্য শহরে এসে সপ্তাহের প্রতিদিনই তিনি কাজ চান। কারণ কাজ করলেই পয়সা হবে। কাজ না থাকলে শহরে আসার অর্থই বৃথা।
খুলনার যুগ্ম শ্রম পরিচালক অধ্যক্ষ খান আখতার হোসেন বলেন, খুলনা বিভাগে ৬৯৯টি ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় আড়াই লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়নের বাইরেও অনেক শ্রমিক রয়েছেন উল্লেখ করে উপ-শ্রম পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় এবং মালিক-শ্রমিক বিরোধ নিষ্পত্তিই তাদের কাজ। ‘শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ এ শ্লোগানকে সামনে নিয়েই আজ সোমবার সারাবিশ্বের ন্যায় খুলনায় মহান মে দিবস পালনে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সহকারী শ্রম পরিচালক আবু বিন আলম।
উল্লেখ্য, আগে শ্রমিকদের প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হত। বিপরীতে মজুরী মিলত নগণ্য। এজন্য ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে।
কিন্তু কারখানা মালিকপক্ষ এ দাবি মেনে নেয়নি। ৪ মে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে হাজারো শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় এটি করেছিলেন।
আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ বাহিনী তৎক্ষণাত শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়েটে রূপ নেয়। রায়েটে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।
পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়।
ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, "আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে"। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়েটের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের " দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার" দাবি অফিসিয়ালি স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে প্রতি বছরের পয়লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন