দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নোনার কবলে
খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবাহমান নদীর পানিতে লবণের মাত্রা এ বছরও বেড়েছে। এই লবণ বাতাস আর পানিতে মিশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। নদীর নোনা পানি আশপাশ অঞ্চলে ছড়িয়ে প্রাণীকূলের জীবনচক্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নির্মিত বিভিন্ন অবকাঠামোর স্থায়ীত্ব নষ্ট হচ্ছে। রোগের প্রাদুর্ভাবসহ নানা ক্ষতি করছে। শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি কম আসা, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নোনা পানিতে মাছ চাষ, বাঁধ নির্মাণ ও জলাধার ভরাটই এর মূল কারণ হিসেবে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে নোনার প্রভাব কমাতে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, পানিতে লবণ বাড়ার সাথে সাথে তা শোষণ প্রক্রিয়ায় মাটিতে প্রবেশ করে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে। এতে করে প্রতিটি জীবের জীবন চক্রের যে ধাপ তা বাধাগ্রস্ত হয়। মাটিতে লবণ বাড়লে জমির উর্বরতা বাড়াতে বসবাসকারী অণুজীবগুলো মারা যায়। এছাড়াও মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য ফলন বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি উদ্ভিদ মারা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, লবণপানি বাস্পিভূত হয়ে বাতাসে মিশে আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে। এতে করে ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র, দালানকোঠাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তাদের স্থায়ীত্ব হারিয়ে ফেলে। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, আমাদের যে জলাধারগুলো রয়েছে তাতে শুষ্ক মৌসুমে জলধারণ ক্ষমতা অনেক কম। কারণ এর গভীরতা কম। পানির উধর্ক্ষমুখী চাপ না থাকলে নোনা সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এছাড়াও নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি কম আসে ফলে সাগরের নোনা পানি বহুদূর অবধি অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে তিনি মনে করেন, আমাদের জলাধারগুলো খনন করে এর গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বৃষ্টির মৌসুমের পানি ধরে রাখার এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শুষ্ক মৌসুমেও পুরোপুরি পানি শুকিয়ে না যায়। পুকুর ও বিভিন্ন জলাশয় ভরাট থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পানিতে লবণের মাত্রা ৫-৬ গ্রাম/লিটারের বেশি হলে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অথচ শুষ্ক মৌসুমে (মার্চ থেকে জুন) নদীগুলোর লবণের মাত্রা লিটারে ১২ থেকে ১৬.৭ গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি মাসে দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি নদীর ৪৪টি পয়েন্টে পানির লবণাক্ততা নির্ণয় করে। গত বছরের তুলনায় এবছরও লবণের পরিমাণ বেড়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ময়ূর নদী গল্লামারী পয়েন্টে লবণের মাত্রা ১.৪ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড) থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭ পিপিটি। একইভাবে বিলডাকাতিয় নদীতে ১.৮ থেকে ২.৩, ভৈরব নদ নওয়াপাড়া ঘাটে ৫.৯ থেকে ৭.১, ভৈরব নদ ফুলতলা ঘাটে ৬.১ থেকে ৭. ২, রূপসা লবণচরা ঘাটে ৭.৬ থেকে ৭.৯, মধুমতি নদীতে ০.৩ থেকে ০.৫, বাগেরহাট দরাটানা নদীতে ১.৩ থেকে ৩.১, বটিয়াঘাট কাজীবাছা নদীতে ৬.২ থেকে ৮.২, কালীগঞ্জ কাকশিয়ালী নদীতে ১৪.১ থেকে ১৪.০৩, কুষ্টিয়া গড়াই নদীতে ০.৩ থেকে ০.৬ পর্যন্ত বেড়েছে।
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, “পানিতে ৫-৬ পিপিটি পর্যন্ত লবণের মাত্রা এ অঞ্চলের পরিবেশের জন্য সহায়ক। এই মাত্রায় টক ফল ধরে এমন গাছপালা ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারে। তবে এর বেশি হলে তা পরিবেশ ও অন্যান্য গাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মাত্রাতিরিক্ত লবণপানি জমিতে প্রয়োগ করলে ধান ও গমসহ অন্যান্য ফসলের ফলন ব্যাহত হতে পারে। পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকলে ক্লোরিন আয়ন শিকড় দিয়ে গাছের পাতায় পৌঁছে সালেকসংশ্লেসন বাধাগ্রস্ত করে। অনেক সময় গাছ মারা যেতে পারে। এছাড়াও মাটি ও পানিতে লবণের উপস্থিতি বেশি হলে ঘনত্বের কারণে ডি-অসমোসিস প্রক্রিয়ায় গাছের তরল মাটিতে উল্টো ফিরে যেতে পারে এতে গাছ রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যেতে পারে।”
লবণের মাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মোঃ মিজানুর রহমান ভূইয়া বলেন, “মাটিতে লবণের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তার উর্বরতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। ধানের থোড় হবে না চিটা বেশি হবে। অনেক সময় চারাই গজাবে না। দীর্ঘমেয়াদীভাবে লবণপানিতে মাছ চাষ করলে সেই মাটিতে ঘাস পর্যন্ত জন্মাবে না। স্যালাইন জোনে বাতাসেও লবণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে করে শহরের দালান-কোঠা, লোহার তৈরি স্থাপত্য, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন