এক অনন্য জ্যোতির্ময় পুরুষ
জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে অনন্য জ্যোতির্ময় পুরুষ- এ অভিধায় অভিষিক্ত করতে চাই।
তিনি গণনায়ক হিসেবে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল, অত্যাচার ও নিষ্পেষণ থেকে শুধু মুক্ত করেননি; তিনি ছিলেন জনগণের প্রাণের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, স্বজন ও আপনজন। তিনি একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য জীবনসর্বস্ব বাজি রেখে আত্মদানের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আহ্বানে গৃহবাসী মানুষ, কৃষক, শ্রমিক তথা দেশের আপামর জনসাধারণ যাদের আধুনিক যুদ্ধ ও মারণাস্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না, তারা পাকিস্তানি দুঃশাসন, নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন।
পাকিস্তানি শাসককুল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে ক্রীতদাসের মতোই গণ্য করত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল বঞ্চিত ও নিপীড়িত।
শেখ মুজিবুর রহমান একের পর এক আগল ভাঙলেন। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা অধিকারের সংগ্রামেও শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম অগ্রপথিক।
তারই পরম্পরায় তার ওপর নেমে এলো আগরতলা ষড়যন্ত্রের উদ্ভট ও মিথ্যা মামলা। সেখানেও সেই অপরাজেয় মানুষটিকে পাকিস্তানি শাসকচক্র অবদমিত করতে পারেনি। তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হলেন।
উল্লেখ্য, তার জীবনের প্রায় অধের্ক সময় কেটেছে কারাগারের বন্দিশালায়। কারাগার ছিল তার দ্বিতীয় গৃহ।
১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটল এবং তারপরই জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল, বাঙালির আপামর জনসাধারণের রাজনৈতিক আশ্রয়, আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হল।
পাকিস্তানি শাসকচক্র, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নানা ছুঁতোয় সংলাপের অবতারণা করে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করতে লাগল। বঙ্গবন্ধু কোনো আপস-মীমাংসায় রাজি হলেন না।
পাকিস্তানি মিলিটারি শাসক ইয়াহিয়া খান ও কুচক্রী রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টোর সব আপস প্রস্তাব ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি অগ্নির মতো জ্বলে উঠলেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ইতিহাসের মহানায়ক ও মহাকবির বক্তৃতা শুধু বাঙালিদের নয়, পাকিস্তানি শাসকচক্রসহ বিশ্ববাসীকে কাঁপিয়ে দিল।
রেসকোর্সে অর্থাৎ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত সেই বক্তৃতা কারও ভোলার নয়। আমি আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত ‘গেটেসবার্গ অ্যাড্রেস’, জন এফ কেনেডির বক্তৃতা
এমনকি ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের ‘Tryst with Destiny’ বক্তৃতাও খুব আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করেছি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালে প্রদত্ত ৭ মার্চের বক্তৃতার কোনো তুলনা আজও আমি খুঁজে পাইনি। সেই বক্তৃতা সাত কোটি বাঙালিসহ বিশ্ববাসীকে বিস্মিত ও উদ্দীপিত করেছিল।
মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন; কিন্তু তা হাতেকলমে সার্থক প্রয়োগ করেছিলেন জাতির জনক, মহান ও শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। তার নির্দেশে প্রশাসনসহ সমগ্র দেশ অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন কাদামাটির মানুষ।
বর্ষায় যেমন নরম হতে জানতেন, তেমনি গ্রীষ্মেও হতেন গ্রানাইট পাথরের চেয়েও শক্ত। দুঃখ আমাদের, এমন একজন মানুষকে আমরা হারিয়েছি, যিনি ছিলেন প্রতিটি বাঙালি ঘরের মানুষ, হৃদয়ের মানুষ, একদিকে শার্দূলের মতো সাহসী, অন্যদিকে বাঙালি মায়ের মতো কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
ইতিহাসের মহানায়ককে নৃশংসভাবে মীরজাফর-বাঙালি ঘাতকদের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিতে হলো।
ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল মানুষের মুক্তিদাতা জন এফ কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী এবং ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেক বিশ্বনেতাকে।
সুদর্শন, বজ কণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের মধ্যে সেরা। একটি লাঞ্ছিত, অপমানিত জাতিকে তিনি মুক্ত করেছিলেন তার অনন্য নেতৃত্বদানের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন এক অপরাজেয় বীর।
যতদিন যাবে, বাঙালির হৃদয়ে আরও গভীর থেকে গভীরভাবে তিনি লালিত হবেন।
বিখ্যাত জননেতা ফিদেল কাস্ত্রো যথার্থই বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখেনি; আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি, যে কোনো সামাজিক বৃত্তের মানুষ তার সাহচর্যে, হৃদয়ের উষ্ণ ভালোবাসায় ও উদারতায় দ্রবীভূত হতেন। তিনি এক মৃত্যুঞ্জয় পুরুষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
Posted by কয়রার সংবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন